সৌগত রায়বর্মন
ডাকু, মতান্তরে ‘বাগী’র দেশ চম্বলে সেবার আমরা। আমরা বলতে কবি মৃদুল দাসগুপ্ত। আমি তখন সদ্য চিত্র সাংবাদিকের পেশায়। আসল কথা হল সেবার প্রচুর কুখ্যাত ডাকুর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল তো বটেই। সেইসঙ্গে ‘অলৌকিক’ চম্বলের মুখোমুখী হয়েছিলাম।
চম্বল একটি নদী। মূলত তিন রাজ্য ঘুরে চম্বল প্রবাহিত। এই নদীর উপত্যকায় বুলেটের শব্দে ময়ূর নাচত এক সময়ে। হয়তো আজও কম-বেশি! বিশেষ করে আগ্রা, মুরেনা, ভিন্দ, গোয়ালিয়র ইত্যাদি জেলাগুলিতে। তৎকালীন ‘পরিবর্তন’ পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে ‘বাগী’ বা বিদ্রোহী ডাকুদের খোঁজখবর নিতেই আমাদের চম্বল যাত্রা। এভাবেই কবি হলেন পুলিশ। মৃদুল দাসগুপ্ত হাবিলদার হলে আমি তাঁর তরুণ কন্সটবল। অবশেষে ‘তুফানোমেল’। আগ্রা, জয়পুর, মুরেনা, ভিন্দ, গোয়ালিয়রের বিস্তীর্ণ ভাঙা মাটির বিহরে বিহরে ডাকাত খোঁজার খেলায় মাতলাম আমরা।
কলকাতাবাসী অজিত সিং-এর একটা চিঠিই ছিল আমাদের সম্বল। চম্বল উপত্যকায় বিহর ঘেঁষা একটি ছবির মত গ্রাম রছেড়ে-তে থাকে সিং-জির ছেলে ও তাঁর পরিবার। চিঠি মাত্র দু’লাইনের। হিন্দিতে লেখা। বাংলা করলে দাঁড়ায়— ‘কলকাতা থেকে আমার দুই মেহমান যাচ্ছে তোমাদের কাছে। ওদের কাজ-কর্ম ও আদর-যত্নের যেন কোনও ত্রুটি না হয়।’
টানা একমাস ধরে চলেছিল আমাদের এক অলৌকিক অভিযান। দেখা হল প্রবাদপ্রতিম ‘বাগী’ নবাব সিং-এর সঙ্গে। বয়স তখন তার একশো সাত। নবাব সিং আবার আর এক প্রবাদপুরুষ মান সিং-এর দাদা। একে একে তহসিলদার সিং, মাধো সিং, রূপ সিং, মোহর সিং প্রমুখদের দেখা হয়েছিল আমাদের। ওদের জীবন কাহিনি ও দর্শন বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝেছিলাম— ওরা ডাকু নয়, ‘বাগী’, অর্থাৎ বিদ্রোহী। অনেকটা রবিনহুডের মতো মসিহা। সমান্তরাল সমাজব্যবস্থা চালায়।
ডাকু বা ‘বাগী’দের সঙ্গে আলাপচারিতা নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার ইচ্ছে আপাতত এই প্রতিবেদকের নেই। চম্বল অভিযানের মধ্যপর্বে যে যুক্তি-অগ্রাহ্য অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়াই উদ্দেশ্য। ঘটনা এতখানি চমকে দেওয়ার মতো যে প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি এতটুকু ফিকে হয়ে যায়নি।
মধ্যপ্রদেশের রছেড় গ্রাম থেকে আমরা উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে গিয়েছিলাম ‘মুক্ত’ তহসিলদার সিং-এর সঙ্গে দেখা করতে। উনি মান সিং-এর ছেলে। শূন্যে কয়েন ছুড়ে সেই কয়েন বুলেটবিদ্ধ করায় ওস্তাদ ছিলেন। যাই হোক, তাঁর সঙ্গে আড্ডা মেরে আমাদের মুরেনা হয়ে ফিরতে হবে রছেড়ে। মাঝ রাস্তায় কিছু বিপর্যয়ের ফলে নির্ধারিত সময়ের বাস পাইনি। পরের বাস সেই সন্ধের সময়ে। অর্থাৎ রছেড়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটা বাজবে। চল্লিশ বছর আগের রাত আটটা। তাও আবার মধ্যপ্রদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ে, যা মোটামুটি মধ্যরাত্রির সমান। কিন্তু যেতে তো হবেই। কারণ পরদিন সকালে মান সিং-এর গাঁয়ে যাওয়ার কথা আমাদের। নবাব সিং রাজি হয়েছেন আমাদের দর্শন দিতে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না।
বাস ছাড়তে ছাড়তে শীতের সন্ধে নামল। আরোহী বলতে আমরা দু’জন, বাস কন্ডাকটর আর দু’একজন বন্দুকধারী দেহাতি। ডাকাত হোক বা না হোক, ওই উপত্যকায় প্রায় সকলেরই কাঁধে বন্দুক থাকে দেখেছি। এটাই রীতি। আমরা একে মেহমান তায় এত রাতে রছেড়ে নামব শুনে ওই বন্দুকধারীরা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাঙালিদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে তাদের যতই উচ্চ ধারণা থাকুক, সাহস নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেই মুহূর্তে নিজেদের বীর বাঙালি ভাবতে আমাদের বেশ গর্ববোধ হচ্ছিল। রছেড় এসে পড়তেই তারা আমাদের সসম্ভ্রমে নামিয়ে দিল। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় আটটা। নামলাম। তারার আলো ছাড়া এক পলতে আলো নেই কোথাও। গ্রামে যাব কোন পথ ধরে? ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এল। আঁধারেরও যে আলো থাকে সেদিন বুঝেছিলাম৷ বাস রাস্তার দুপাশেই যে রছেড় গ্রাম, তা জানতাম। কিন্তু বিস্তীর্ণ যবের ক্ষেত পেড়িয়ে কোনদিকে যাব? হালকা কুয়াশায় দূরের সবকিছু অদৃশ্য ও মায়াবী! এই শীতে সারাটা রাত খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে বরফ হওয়া মরা নিশ্চিত বুঝে রওনা দিলাম বুক ঠুকে৷ একটাই ভয়, ভুল করে যদি বিহর দিয়ে নেমে যাই, তাহলে হাজার বছরেও কেউ খুঁজে পাবে না। প্রত্নতত্ত্ব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং খেতের ভিতর দিয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু পথ যে শেষ হয় না৷ দূরে একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে যেন! ওই আলোর দিকেই যাওয়াই সুবিধা মনে করলাম। কিন্তু ওটা আলো না মরিচীকা! বুঝতে পারছিলাম না। আর এগোতে পারছিলাম না। কারণ আলো ক্রমশ যেন উল্টো দিকে যাচ্ছে! কিন্তু তখন আমাদের শ্যামাপোকার দশা। আলোর উৎসে পৌঁছতেই হবে৷ হায় হতোস্মি! এবার শুরু হল নতুন খেলা— আলো একবার ডানদিকে যায়, একবার বাঁদিকে। আলো নড়ছে, নাকি আমরা সরে সরে যাচ্ছি বুঝতে পারছি না! তবে কি আলেয়া? আলো হোক বা আলেয়া, একসময়ে টিমটিম করতে করতে নিভে গেল! বেশ কিছুক্ষণ স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। এবার উপায়? কোনদিকে যাব? এবার ভয় গ্রাস করছে আমাদের। প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া মুহূর্তে টুংটাং আওয়াজ শুনলাম। নিশুতি রাতে বোঝা যায় না শব্দের উৎস। ছোট্ট ঘণ্টির আওয়াজ, যা থাকে গরু বা ছাগলের গলায়। কিন্তু ওটুকুই আকড়ে ধরলাম আমরা। ধরে যেন প্রাণ এল। তাহলে সামনেই কোনও গোয়াল ঘর আছে৷ তার মানে গ্রামও দূরে নয়। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। টুংটাং আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। অন্ধকারে আওয়াজ আন্দাজ করে যেতে যেতে সত্যিই পেলাম একটা গোয়াল ঘর। তাতে গরুও আছে৷ গলায় ঘণ্টি৷ আমরা এবার চিৎকার শুরু করলাম- ‘পালোয়ান সিং, ঠাকুর সিং! হামলোগ কলকাত্তা সে আয়া, আপলোগ কাঁহা হো?’ নাহ, কোনও আওয়াজই নেই। এবার নিরুপায় হয়ে গ্রাম খুঁজতে বেরোলাম। কোথায় গ্রাম? একটা ছোটখাটো জঙ্গল। ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। উঁচু-নিচু রাস্তা। মনে হচ্ছে মাটির গর্ত দিয়ে হাঁটছি। আমাদের তীব্র চিৎকারও কারো কানে যাচ্ছে না। ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই আওয়াজ। সেই গোয়ালঘর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার খোঁজার পালা। এবার অন্য পথে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আবার সেই গোয়াল, সেই গরু। কিন্তু চেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে৷ কিন্তু কি আশ্চর্য! আবার সেই গোয়ালঘর। সেই গরু ও টুংটাং শব্দ। বুঝলাম আমরা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি। যেন এক চুম্বকের টানে বার বার একই জায়গায় ফিরে ফিরে আসছি। সুতরাং একটা সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত মনে হল। তা হল অপেক্ষা করা। তারপর গোয়ালঘরেই রাত কাটাব বলে ঠিক করলাম। ক্লান্তিতে, টুংটাং আওয়াজে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙতে বুঝলাম আমরা তক্তাপোষে শুয়ে আছি। মাথা কাত করতে পারছি না। দুর্বল। চোখে পড়ল, পালোয়ান সিং মুখের উপর ঝুঁকে। সিং-জি বাংলা জানে৷ কলকাতায় দীর্ঘদিন চাকরি করেছে। পরিস্কার বাংলায় যা বলল তা হল, আমাদের পাওয়া গেছে রছেড় থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে নবাবগঞ্জের এক গোয়ালঘরে। আমরা প্রায় মৃত অবস্থায় সেখানে পড়েছিলাম। প্রবল শীত আর ভয়ে আমরা প্রায় কাঠ হয়ে শুয়েছিলাম। ওরাই গরম দুধ পলতে ভিজিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে আমাদের বাঁচায়। ওরা জানত যে আমরা ‘পত্রকার’ (সাংবাদিক)। কলকাতা থেকে রছেড়ে এসেছি ‘বাগী’দের নিয়ে বই লেখার জন্য।
এরপর গরুর গাড়ি করে নবাবগঞ্জের লোকেরাই আমাদের রছেড়ে পৌঁছে দেয়। গায়ে তখনও জ্বর। তবে গরম দুধ খেলেই শরীর আগের মত চাঙ্গা হয়ে যাবে জানতাম।
কিন্তু আমরা ভাবছিলাম, গতকাল রাতে পনেরো কিলোমিটার কিভাবে পাড়ি দিলাম? পালোয়ান সিং বলল, ভুল করে বিহরে ঢুকে পড়েছিলাম। বেরিয়ে আসার কোনও উপায় ছিল না৷ গরুর টুংটাং শব্দেই আমরা বিহর থেকে উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু শর্টকাটে পনেরো কিলোমিটার দূরে ততক্ষণে আমরা সরে গেছি। আলোগুলো যে আলেয়া তাতে কোনও সংশয় নেই কিন্তু গোয়ালঘরটা কি তাহলে চৌম্বকক্ষেত্র? এনার্জি ফিল্ড? বিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামাবার মত মনের অবস্থা তখন ছিল না।
আজ চল্লিশ বছর পর যখন ভাবি, তাহলে কি কোয়ান্টাম মেকানিক্স, এখন তো এসব নিয়ে গবেষণা চলছে। চৌম্বকক্ষেত্র মিথ্যে নাও হতে পারে৷