Home / সান-ডে ক্যাফে / সাঁকো ও পতনকালীন ইন্দ্রজাল

সাঁকো ও পতনকালীন ইন্দ্রজাল

 সরোজ দরবার

 

সাঁকোটা যে ছিল, তা তো সকলেই জানত। আর নিচে জল, মূলত নোংরা জল বইছে তাও জানা কথাই। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যেই যে ইন্দ্রজালের শক্তি আছে, তা কেউ জানত না। সাঁকো থেকে জল, এই দূরত্বে বা বলা যায় এই ফাঁকা জায়গাতেই আছে ম্যাজিক।

বার্তাটি ক্রমে রটে গেল। সৌজন্যে বেতো নিকুঞ্জ। গোড়ালিতে বাত তার। সেই কবেকার। নিকুঞ্জ জানে, বাপ তার জন্য বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেনি। কিন্তু এই বাতের উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে। যা তাকে বয়ে বেড়াতেই হবে।

বাত বলে অবশ্য নিকুঞ্জ বসে থাকে না। সে হেঁটে হেঁটেই সব কাজ করে বেড়ায়। কিন্তু এখানে একটা হিসেব এবং গরমিল আছে। ধরা যাক, রাস্তা ইটের। নিকুঞ্জ ভাবছে, সে একসঙ্গে চারটে ইট পেরোবে। সেইমতো পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু গোড়ালির বাত তাকে খানিকটা পিছনে টেনে রাখছে। ফলে হয়তো সে আড়াইটে কি তিনটে ইট পেরোল। এখন, এই পর্বে তার টার্গেট কমিয়ে তিনটে ইট করা উচিত। কিন্তু এখানেও সে ভাবতে থাকে, তিনটে নাকি চারটেই পেরোবে! এবং শেষমেশ আবার চারটের জন্যই পা বাড়ায় ও অবধারিত পিছিয়ে পড়ে। এ সবই অবশ্য পলক ফেলার আগেই ঘটে যায়। লোকে শুধু দেখে গোড়ালিতে বাতের কারণে নিকুঞ্জ পা টেনে টেনে চলছে। ফলে পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেতে সে পনেরো মিনিট সময় নেয়। কিন্তু এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে আবার বেজায় খেপেও যায়।

তো এই নিকুঞ্জ একদিন সাঁকো পেরচ্ছিল কোনও কারণে। সাঁকোটা ঠিক কোথায় তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। পৃথিবীর সব সাঁকোই মূলত দুটি ভূ-খণ্ডের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু তো নয়। নিকুঞ্জ তার এই বাতের কারণেই সেদিন একেবারে সাঁকো থেকে নিচের জলে গিয়ে পড়ল। আর কী আশ্চর্য, এই পতনকালেই, প্রায় দৈবশক্তির মতো সে অনুভব করল সেই আশ্চর্যকে। যে শক্তি এসে তার গোড়ালির ব্যথাটুকু মিলিয়ে দিয়ে গেল।

জল থেকে ওঠার সময়ও সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু এরপর যখন গটগট করে হেঁটেই ঘরে ফিরল, তখন আর বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। নিকুঞ্জেরও না এবং বহুসংখ্যক মানুষেরও না।

অতএব সাঁকো থেকে পড়লেই বাত সারে। বার্তাটি ক্রমে দূরে দূরে এবং আরও বহুদূরে রটে গেল।

 

কিন্তু পড়লেই তো হল না। পড়ার মতো পড়তে হবে। নইলে ওই দৈবশক্তিকে নিজের মধ্যে চালনা করা যাবে কেন!

“তা কী করে সম্ভব নিকুঞ্জ?” কলরব প্রশ্ন করে।

এই মুহূর্তে নিকুঞ্জকে ঘিরে আছে বহু বেতো মানুষ। কত হবে? এক দুই তিন চার… ধুর, জনগণকে গোনা যায় নাকি! তারা সকলেই জানতে চাইছে, পড়া তো বোঝা গেল, কিন্তু কীভাবে পড়তে হবে?  আসলে নোংরা জলে কে আর সাধ করে পড়ে! কিন্তু সামান্য নোংরা কম্প্রোমাইজ করে যদি ওই আশ্চর্য শক্তির কৃপা পাওয়া যায়, তবে আপত্তি কীসের! সুস্থ হলে নোংরা না হয় ধুয়ে নেওয়া যাবেখন। সকলেই মোটামুটি এরকমই ভাবছে এবং তাই তারা নিকুঞ্জর উত্তর শুনতে যারপরনাই উৎসুক।

বেতো নিকুঞ্জ ( টেকনিক্যালি যদিও এ কথা আর বলা যায় না। তবু ব্যক্তি এক জেনেও আমরা যেমন দলীয় নেতা সাংবিধানিক পদাধিকারীকে আলাদা সম্ভাষণ করি পৃথক আইডেন্টিটির নিরিখে, সেরমই বিপ্রতীপে আপাতত ধরে নেওয়া গেল যে, বেতো আর না-বেতো নিকুঞ্জ একই ব্যক্তি।) তাই বলতে শুরু করে। বলে, “সেদিন এগোচ্ছি তো এগোচ্ছি। যত এগোচ্ছি তত মনে হচ্ছে এই বাত থেকে কি মুক্তি নেই? বুড়ো পৃথিবী পর্যন্ত একই তালে ঘুরতে পারে, আর আমি কি বাতমুক্ত হতে পারি না? কোনওদিন কি ব্যথামুক্তির সুদিন আসবে না? ভাইসকল, যারা বছরের পর বছর বাতে ভুগছ, বলো, এরকম এক এক সময় মনে হয় কি হয় না? হওয়াটা স্বাভাবিক কি স্বাভাবিক নয়?”

বেতো জনতা সমস্বরে বলে, “বটেই তো! খুব স্বাভাবিক।”

নিকুঞ্জ আবার বলে, “এই ইচ্ছেশক্তিটা কিন্তু জোরদার করতে হবে। নিজের ভিতরে এমন এক ইচ্ছের জন্ম দিতে হবে যা বলবে, এই বাত আমার শরীর থেকে বেরিয়ে পারে তো শত্রুকে ধরুক। আমি কিন্তু কিছুতেই আর বাতের কবলে থাকব না।”

এবার ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে, “কিন্তু মানুষ তো কথার কথা বলে, শত্রুরও যেন এমন ক্ষতি না হয়… তাহলে বাতের বেলায়…!”

নিকুঞ্জ চুপ। কলরবই জবাব দিয়ে বলে ওঠে, “চুপ কর আঁটকুড়ের ব্যাটা। সবেতেই দোষ ধরা! থাক তুই তোর বাত নিয়ে, আজীবনের বেতো হয়ে।”

জনতার ভরসা পেয়ে নিকুঞ্জ এবার বলে, “ভাবতে ভাবতে কখন যেন সাঁকোর মাঝখানে চলে গেছি। এদিকে ভিতর থেকে ইচ্ছেটা প্রবল হতে শরীর একেবারে হালকা হয়ে উঠেছে। যেন মাথার ভারটুকুও আর নেই। দাঁড়াতেই যেন আর পারছি না। ভেবে দেখলাম, মাঝামাঝি অবস্থায় পিছনো বা এগনো— দুটোতেই সমান কষ্ট। তাহলে কী করি! হঠাৎ যেন শরীরটা পাতার মতো হয় গেল। কোত্থেকে ব্যাপক হাওয়া উঠল। আর আমি নিচে পড়তে শুরু করলাম। আর তখনই সেই প্রবল ইচ্ছেশক্তি দৈব হয়ে আমাকে ধারণ করল। আমার শরীর থেকে বাত যেন স্লেটে ভেজা তুলি বুলিয়ে দাগ মুছে দেওয়ার মতো মুছে দিল কেউ! আর আমি সুস্থ হয়ে গেলাম। সুতরাং বন্ধুরা, আগে ওই বাতমুক্ত হওয়ার ইচ্ছেটা জোরদার হতে হবে। মনকে জাগিয়ে তুলতে হবে যে, এবার বাত থেকে বেরনোর সময় হয়েছে। কী জাগাতে পারবেন না, পারবেন না?”

ব্যাপক করতালির সঙ্গে বেতো জনতা বলল, “নিশ্চয়ই পারব। পারতেই হবে।”

ঠিক হল, এক রবিবার বেতোরা দলে দলে গিয়ে সাঁকো থেকে ঝাঁপ দেবে। আর পতনকালের শক্তিতে সব আশ্চর্য সুস্থ মানুষ হয়ে উঠবে।

 

আজ সেই রবিবার। সবই ঠিকঠাক আছে। দলে দলে বেতোরা হাজির ইতিমধ্যে। কিন্তু সামান্য একটু গোল বেধেছে। কারণ, ঝাঁপ সংক্রান্ত একাধিক অস্বস্তিকর প্রশ্ন এর আগে খতিয়ে দেখা হয়নি। অথচ কার্যকালে সেগুলো এড়ানোরও উপায় নেই।

প্রথমত, সাঁকোর সয্যের একটা সীমা আছে। সুতরাং ঠিক কতজন মানুষ ঝাঁপ দেওয়ার পর সাঁকোটি ভেঙে যেতে পারে, তা কেউ জানে না। নতুন সাঁকো নির্মাণ করাই যায়। কিন্তু তখনও সাঁকো এবং পতনকালের দৈব শক্তি বজায় থাকবে কি না, সে ব্যাপারে স্বয়ং নিকুঞ্জও নিশ্চিত নয়। সুতরাং, এখন মূল প্রশ্ন, কে বা কারা আগে ঝাঁপ দিতে যাবে? বয়ঃক্রম অনুযায়ী সাজানো যেতে পারে। কিন্তু এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে জোয়ান লোকটাই বেতো। সে যদি সুস্থ হয় তবে পরিবারটা বেঁচে যায়। অগ্রাধিকার তার প্রাপ্য বটে। এদিকে একজন বয়স্কেরও সুস্থ হওয়ার সমান অধিকার আছে। সেখানে হস্তক্ষেপ করলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে।

আবার দেখা যাচ্ছে, কোনও অঞ্চলে বেতো বেশি। তাদের সকলকে একসঙ্গে সুযোগ না দিয়ে, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত অনুন্নত বা উপদ্রুত অঞ্চলের বেতোদের আগাম সুযোগ দেওয়া বাঞ্চনীয়। তাতে সার্বিক উন্নতির রাস্তা খোলে।

এরকম বেশ কয়েকটা জটিল প্রশ্নের সমাধান খুঁজছেন সকলে।

দ্বিতীয়ত, সাঁকো মানেই তা দুটি ভূ-খন্ডকে জুড়ছে। ফলে এদিকের না ওদিকের, কোন ভূখণ্ডের মানুষের অগ্রাধিকার বেশি, বা কোনদিক কতটা সুবিধা পাবে, তা নিয়েও যথেষ্ট তর্ক আছে।

এই সমস্ত তর্ক ও প্রশ্নের একটা যৌক্তিক সমাধান খুঁজে পেলে তবেই সেই অলৌকিক ঝাঁপ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। মাতব্বর ও মোড়লরা বেতোদের ধরে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। রফা খুঁজছেন। বেতোদের উদ্ধারের দায় তো তাঁদেরও কম নয়! যাদের পেটে একটু বিদ্যেবুদ্ধি আছে, তাঁরাও সমস্ত সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন। কী করা যায়! কাউকে বঞ্চিত না করে, এত বৈচিত্রের মধ্যে সমতা বিধান করে কীভাবে ঝাঁপ সম্পন্ন হতে পারে, তা বেশ জটিল ভাবনাই বটে!

ঠিক এই গোলমালের সময়টায় কিছু মানুষ নিকুঞ্জকে ঘিরে আছে। সে প্রায় ভগবান বুদ্ধের মতো বসে। যত তার দৈবী ঝাঁপের গল্প সে বলছে, যত সেই আশ্চর্য জাদুকরী শক্তির প্রতি প্রতীতি জন্মাচ্ছে মানুষের, তত একটু একটু করে খোদ নিকুঞ্জই অবতার কিংবা অলৌকিকে পরিণত হচ্ছে।

ক্রমে বেলা বাড়ে। বাড়তেই থাকে। তবু সমাধান আর মেলে না। রোদ চড়চড়ে হয়। লোকের খিদে পায়। মাথা গরম চেঁচামেচি বাড়তে থাকে। কলহ, কলরবে টেকা দায় হয়ে ওঠে। এবং এই এতকিছুর মধ্যে সংবিৎ ফিরলে একটা সময় সকলে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, সাঁকোটাই যে আর নেই! জাস্ট নেই। সক্কলের চোখের সামনে অথচ অগোচরে কখন যেন বেমালুম উবে গেছে। ‘ছিল, নেই- মাত্র এই।’

তখন সকলেই নিকুঞ্জের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কী অপরাধ হল প্রভু! কোনওভাবেই কি সাঁকো ফেরানো যায় না! এত বেতোর কি মুক্তি নেই? কিন্তু সে তখন পাথরের মতো বসে আছে। যেমন যদুকুলপতি হয়েও কৃষ্ণ ঠেকাতে পারেননি মৌষলকাল। যেমন রক্ত দিয়েও যিশু মুছতে পারেননি হিংসা। দেখে মনে হয়, যেন ওরকমই এক মহাকাব্যিক হতাশা গ্রাস করেছে তাকে।

কতক্ষণ নিকুঞ্জ এভাবে বসে ছিল তার ঠিক নেই। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমে হেলেছে। ক্রমে তার সারা শরীর লাল হয়ে ওঠে। চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। নিশ্বাস পড়ে ফোঁসফোঁস করে। তারপর আচমকা সে উঠে সবাইকে সরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে কোনদিকে যেন মিলিয়ে যায়। কেউ আর তার নাগাল পায় না।

সন্ধে নামার মুখে বেতো জনতা শুধু বুঝতে পারে, এবার তাদের একা একাই ফিরতে হবে। পা টেনে টেনে। কে জানে ঘরে পৌঁছোতে কত অন্ধকার হয়ে যাবে!

 

[ সম্পাদক বলবেন, গল্প এখানেই শেষ। বাস্তবিক তাই-ই। তবে যে কথা না বললেই নয়- গল্পটি বেশ পুরনো এবং সম্ভবত কিছু ফাঁকফোকরও আছে। কিন্তু প্রচলিত, চালু গল্প। ফলে কথকের কিছু করার নেই। সম্প্রতি গল্পটি নতুন করে আলোয় ফিরেছে। কারণ যুক্তি নাকি বস্তুবাদীদের কেউ কেউ বলছেন, সাঁকো তো আর অমন উবে যেতে পারে না। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ এরকম কোনও সাঁকো ছিল তো? এখন, এর উত্তর কে দেবে? সাঁকোর গল্পের সত্যি-মিথ্যা যে সবথেকে ভাল বলতে পারত, সে নিকুঞ্জ। কিন্তু দেবতা তো কোনও কিছুরই উত্তর দেয় না। আর মহানিষ্ক্রমণের পর সকলেই যে দেবতা হয়, তাও জানা কথা।

তবে চাইলে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। কারণ নিকুঞ্জ মন্দির আজও আছে। সেখানে দুবেলা আরতি হয়। ভক্তেরা পঞ্চপ্রদীপের তাপ কপালে-বুকে ঠেকিয়ে নিতে নিতে আজও বিশ্বাস করে, গোড়ালির বাত একদিন ঠিক সেরেই যাবে। ]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Spread the love

Check Also

প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে বিয়ে, করোনায় মৃত্যু হল বরের দাদার

চ্যানেল হিন্দুস্তান ব্যুরো: করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বড় জমায়েত করে আচার-অনুষ্ঠান করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে প্রশাসনের। …

গুণমান খারাপ বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের, চিনের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের

চ্যানেল হিন্দুস্তান ব্যুরো: ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চিনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে ২০ জন …

শান্ত প্যানগং বিগত ৫০ বছর ধরে কেন ভারত-চিন সীমান্ত উত্তেজনার বড় কারন? জানুন ক্লিক করে

চ্যানেল হিন্দুস্তান ব্যুরো: ভারত ও চীনের সেনার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ফলে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *