তন্ময় চক্রবর্তী
শীতের রোদ্দুর এসে পড়েছে গাছের পাতায়। রাস্তার বাঁক ঘুরতেই অতিকায় এক আশ্চর্য দরজা। কবি দরজা ঠেলে ঢুকলেন। সামনে এক সুদর্শন। প্রশান্ত মুখে বললেন, ‘দাঁড়ান, একবার দেখে নিই।’
পলেস্তরা-খসা পুরনো বাড়ি। সারা ঘরে ছড়ানো বই। রং-চটা দেওয়াল। আসবাব বলতে একটি চৌকি ও মাঝারি এক লেখার টেবিল।
মৃদু হেসে সুদর্শন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কবি’?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি সামান্য হাসলেন। মন-কেমনের হাসি।
সুদর্শন সেই আশ্চর্য খাতায় লিখে নিচ্ছেন, আমরা রইলাম, চুম্বনের ক্ষত, কালো রঙের আগুন, হ্যাঁরে শাশ্বত, সাত মিনিট ঝড়, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, বিপজ্জনক, অঙ্কে যত শূণ্য পেলে, বসন্ত মস্তান, শরীর কাচের টুকরো, নিষিদ্ধ এক গানের মতো ইত্যাদি।
লেখা থামিয়ে বললেন, ‘একটা উপন্যাসও আছে দেখছি, অকালবসন্ত’।
এই মুলুকে পুরনো কথা সব লিখে রাখতে হয়। যেমন, কবি ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন খুন হন তার বাবা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে পাঠক্রমের প্রায় শেষদিকে পড়া ছেড়ে দেন শুধু কবিতা লেখার নেশায়। প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিয় গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস, ভাল লাগে তার কবীর সুমনের গান। ভালবাসা বলতে কৃত্তিবাস, তরুণ কবি আর নতুন বন্ধু ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
‘যা শীত পড়েছে। একটা সিগারেট হবে? সন্ধে হলে না হয় অন্য কথা ছিল। এখানে তো বন্ধুরা কেউ নেই দেখছি’।
সুদর্শন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কবির দিকে। জিগ্যেস করলেন, ‘কি ভাবছেন?’
‘ভাবছি, দাঁড়াবার জায়গা আর কৃত্তিবাসের এবারের বইমেলা সংখ্যাটা আর দেখা হল না। কত লোককে যে কত কবিতা দেবার কথা দিয়ে রেখেছিলাম।’
কথা শেষ না হতেই সামনে একটি ছোট টুলে দেখতে পেলেন কিছু ধূসর বই। হাতে তুলে নিতেই, ও মা, কী আশ্চর্য! এ তো তার বসন্ত মস্তান! পাতা উল্টোতেই–
রেল লাইনের দু’ধারে আজকে
ঝান্ডা তুলেছে পলাশ
পাতাঝরা শীত সরিয়ে আসবে
বসন্তপঞ্চমী
প্রথম সারিতে স্কুলের মেয়েরা
সবাই সরস্বতী
তার পরদিন ভালবাসবার
সন্ত ভ্যালেন্টাইন…
মিটিমিটি হাসছেন সুদর্শন। তারও হাতে একটি বই। নিষিদ্ধ এক গানের মতো। পাতা খুলতেই পঞ্চশরের একটি—
‘পঞ্চশরের একটি শর ব্রায়ের স্ট্র্যাপ
সবুজ লেসের লুকিয়ে রাখা গন্ধ পাই’…
কবির মুখে হাসি ফুটে উঠল। সুদর্শন বললেন, ‘কোন কবিতাটা আসরে লোকে সবচেয়ে বেশি শুনতে চাইত?’
কবি লাজুক। বললেন, ‘সে এক প্রথম দিকের বই— অংকে যত শূন্য পেলে’। কবিতার নাম, ‘পুত্রার্থে’।
‘গত ১১টা মায়ারানি গো, এসো। আহা লাগুক
গায়ে পা লাগুক, পরে প্রণাম করে নিও। ভাদ্র মাস
…এহে, এরই মধ্যে ঘুমুলে নাকি, মায়া?’
দুপুর গড়াল। গড়াল গল্পও।
‘বিয়ে করিনি বলে কি প্রেম করতে পারি না?’
সুদর্শন লাজুক চোখে মেলে ধরলেন ‘যতই আসুক বর্ষা বাদল’।
‘আনব তোমায় যতন করে
মাথায় ধরব রঙিন ছাতা
দুধে-আলতা পা দুখানি
মুছিয়ে দেব হৃদয় দিয়ে’
কবি তার হাতে তুলে দিলেন ‘বিরহিনী’ কবিতার পাতা, মলাটে লেখা ‘অঙ্কে যত শূণ্য পেলে’।
‘মেসের রুমমেট ঘুমিয়ে পড়লেই চিঠি খুলল সে
…
ফিরিয়া আসিয়ো নাথ। তাড়াতাড়ি এসো।
কলিকাতা কালেজের ছুটি কবে পড়িবে গো।
এনভেলাপের মুখে দিব্যি লেখাঃ ‘খুলিবে না, সাড়ে চুয়াত্তর।’
হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘বাংলা অ্যাকাডেমির সামনে এত ভিড় কেন? শিবাশিস সবাইকে ডাকছেন। শ্রীজাত থামের আড়ালে। সুবোধদার হাতে কবিতা অকাদেমি লেখা প্রকান্ড এক মালা। ম্যানেজার দিব্যেন্দু ছোটাছুটি করছে। সুদীপ এককোনে চুপ বসে আছে। হিমবন্ত এসে পড়লেন না? গাঢ় নীল ফুলহাতা সোয়েটারে বিনায়ক ম্লানমুখ। শমীন্দ্র শান্তিনিকেতন থেকে কবে এল? সুমন সেনগুপ্ত, প্রসূন ভৌমিক, পায়েল, কৌশিক পাল, বিশ্বজিত, সম্রাজ্ঞী, দূর্বা, অদিতি, বিপ্লব—ওদের এখানে কী দরকার? সৌরভ মুখোপাধ্যায় হন্তদন্ত হয়ে ফোনে কার সঙ্গে, কিছুক্ষণ আগে মনে হল আনন্দ’র সুবীরদাও যেন…’।
কৃত্তিবাসের ধনঞ্জয়দা, দে’জ-এর অপু, তিমির, প্রতিভাস-এর বীজেশদা, সৌমিত্র মিত্র, প্রণতি ঠাকুর— ওদের মুখ এত গম্ভীর কেন? আরে রূপক, ওই তো!
দাঁড়াবার জায়গার নারায়ণদা, সোহম, উপাসনা, উষসী, অনির্বাণ, শান্তনু, শৌভিক সরকার, মন্টি….. সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। শ্যামলী আসেনি? ওর সঙ্গেই তো প্রতি বছর দাঁড়াবার জায়গা পত্রিকার ইন্টারভিউ নিতে যাই।
সন্ধে নামছে। রাস্তা জুড়ে অনেক লোক। নদীর পাড়ে অংশুমান, অভিজিৎ, সূপর্ণা, বাঁশবেড়িয়ার আরও কত চেনা মুখ।
হঠাৎ চেনা গলা। ‘এ কি! পিনাকী! এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?’
‘আরে সুনীলদা!’
ধুপ করে এক প্রণাম।
‘তখন দামি ছিল কলম, হাতঘড়ি
তখনও টেলিফোন বড়লোকের
সিনেমাহলে ছিল ব্ল্যাকার ঝাড়পিট
কোথায় কোয়ালিটি আইসক্রিম?’
রাত্রির কুয়াশায় মিলিয়ে গেলেন দুই কবি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তন্ময় চক্রবর্তী কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘কৃত্তিবাস’, ‘মহাশ্বেতা দেবী’, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’ সম্মান। কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৯। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ডোভার লেনের রাত্রি’(সিগনেট প্রেস), ‘আমার রবিঠাকুর’ (প্রতিভাস) এবং beyond borders (A Poetry book of Trans creation) ……. দেশে-বিদেশে কবি হিসেবে আমন্ত্রিত। সম্প্রতি গল্প ও ফিচার লেখার পাশাপাশি অনুবাদের কাজও করছেন।
………………………………..
শীর্ষ অলঙ্করণ: কুনাল