ডম্বরুপাণি উপাধ্যায় :
টাইগার।
ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে এই শব্দটি উচ্চারণ করলে যাঁর নাম মনে আসে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট কে সাবালক পর্যায়ে তুলে আনা মনসুর আলি খাঁ পতৌদি।
ভারত কে ম্যাচ জিততে শেখানো মনসুর আলি খাঁ পতৌদি।
প্রথম প্রথম তাঁর খেলা দেখে দর্শকরা বুঝে উঠতে পারতেন না তিনি ভাল খেলছেন না খারাপ! এমন শট মারতেন, দেখে মনে হত এই বুঝি ক্যাচআউট হয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর ব্যাট থেকে যে ক্যাচ উঠত সে ক্যাচ কেউ ধরতে পারতেন না। একবার বা দু’বার নয়, বারংবার এ হেন ‘ক্যাচ’ মিস করতেন ফিল্ডাররা। ক্রমে দর্শক বুঝতে পারলেন, আসলে ওগুলো কোনওটাই ক্যাচ নয়। ওগুলো লিফটিং শট। বল বাতাসে ভাসবে ঠিকই কিন্তু এমনই অ্যাঙ্গেলে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে যাবে যে তাঁরা কোনওদিনই ধরতে পারবেন না।
এমন অনেক চমক ছিল নবাবের ক্রিকেটে।
ফিল্ডিং করার সময় লং-এ ক্যাচ উঠলে আর পাঁচটা সাধারণ ক্রিকেটারের মত তিনি বলের দিকে চোখ রেখে ধাওয়া করতেন না। একবার বল টা দেখে নিতেন, তারপর দৌড় শুরু করতেন। যেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরতেন সেখানেই বলটা পড়ত, এবং তিনি সহজ ভঙ্গিতে তা করতলে ধারণ করতেন।
এই ছিল পতৌদির ক্রিকেট।
রাজ্য রাজনীতি তে ক্রিকেটার হতে হতে রাজনীতিক হয়ে ওঠা মুকুল রায়ের খেলাটাও অনেকটা সেই রকম।
প্রথম প্রথম ধরা যায় না, পরে অনুধাবন করতে হয় তাঁর খেলার মোক্ষম প্রকোপ। যাঁরা তেমন সমঝদার নয়, তাঁরা অবশ্য কোনওদিনই বুঝে উঠতে পারেন না।
সম্প্রতি মুকুল রায় বলেছেন, তিনি আর খেলবেন না (পড়ুন রাজনীতির কলাকৌশলে অংশ নেবেন না)। প্রত্যাশামতই রাজ্য রাজনীতির যে অংশটি (এর মধ্যে তথাকথিত অরাজনৈতিক অংশও আছে) মনে করে মমতা তথা তৃণমূলের জন্য মুকুলই সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা, তাঁরা বুঝে বা না বুঝে মুকুলের খেলা ছাড়ার বিষয়টি নিজেদের মত ব্যখ্যা করেছেন। মোটের ওপর ব্যখ্যা টি সরল। বিজেপিতে চাপে রয়েছেন মুকুল, শুভেন্দুর আগমনে তাঁর গুরুত্ব কমেছে, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার দৌড়ে তিনি পিছিয়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের ব্যখ্যার আতিশয্য দেখে বারুইপুরের সভায় মুকুল মৃদু প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন। বলেছেন, আপাতত তিনি ব্যাট তুলে নিলেও দরকার হলে স্লগ ওভারে খেলবেন। ক্রিকেট যাঁরা জানেন তাঁরা বোঝেন স্লগ ওভার বলতে শেষ দশ ওভারের খেলাকে বোঝানো হয়।
পতৌদির মত মুকুলও এক সময় তৃণমূলকে জিততে শিখিয়েছিলেন। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত থেকে এই জয়ের শুরু। তার আগে পর্যন্ত মমতার তৃণমূল দারুন খেলে হারত। প্রচারের ঝড় উঠলেও, ভোট বাক্সে সে ঝোড়ো বাতাস পৌঁছত না।
উনিশের লোকসভা ভোটেও বিজেপিকে জয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন এই পতৌদি থুড়ি মুকুলই।
এবার সামনে একুশের ভোট।
তৃণমূল রাজনীতি তে যাঁরা মুকুলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেন নি, প্রধানত তাঁরাই এখনও পর্যন্ত নিজেদের গায়ের ঝাল ঝাড়ছেন। এবং মুকুলের ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়ে বামনসম আনন্দ পাচ্ছেন।
অমিত শাহ অনেকদিন আগেই প্রকাশ্য জনসভায় বলে গেছিলেন উনিশের জয়ের কারিগর মুকুলই।
এ হেন মুকুল যখন ভোটের মুখে এসে বলছেন, তিনি আপাতত খেলবেন না তখন কয়েকটি রাজনৈতিক ভাবনার উদয় হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রথমত, মুকুল কি মনে করছেন একুশের জয়ের লক্ষ্যে তাঁর যা করার ছিল তা তিনি ইতিমধ্যেেই করে ফেলেছেন?
খুব কম করে ধরলেও গেরুয়া শিবিরের হিসেবে ১৬০ থেকে ১৮০ টি আসন নিয়ে সরকার গড়বে বিজেপি।
উত্তরবঙ্গ, দুই মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, আংশিক উত্তর ২৪ পরগনা ও জঙ্গলমহলে ভাল ফলের আশা করছে বিজেপি।
মুকুল আপাতত ব্যাট তুুলে নিলে বুঝতে হয় ক্ষমতায় আসার কাজটুকু তিনি ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন।
দ্বিতীয়ত, শুভেন্দুকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে কুণ্ঠা করছেন না মুকুল। বারুইপুরে তিনি রাখঢাক না করেই বলেছেন, শুভেন্দুই একুশের লড়াইয়ের মুখ। যে স্বীকৃতি শুভেন্দু তৃণমূলে পান নি বলে মনে করা হয় সেই স্বীকৃতি শুভেন্দুকে দিতে কার্পণ্য করেন নি মুকুল।
তৃতীয়ত, শুধু এ রাজ্যের নয়, গোটা দেশের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দলের নবীন প্রজন্মের কম বেশী অভিযোগ ‘বুড়োরা’ জায়গা ধরে রাখার ফলে তাঁরা সুযোগ পান না। বিষয়টা এইভাবে দেখলে, জায়গা ছেড়ে দিয়ে নজির তৈরি করলেন মুকুল।
পতৌদি যেভাবে বেদী বা চন্দ্রশেখর কে বলে দিতেন বল টা ঠিক কোন জায়গায় পিচ করাতে হবে, মুকুলও আপাতত সে ভাবেই প্রয়োজনীয় টিপস দেবেন শুভেন্দু আর রাজীবকে।
স্লগ ওভারে দরকার পড়লে নামবেন…
তখন আবার খেলা হবে!