কণাদ দাশগুপ্ত :
আবেগতাড়িত নয়, কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়৷
ব্রিগেড মঞ্চের পটভূমিতে আব্বাস সিদ্দিকিকে ব্যবহার করে খুব ঠাণ্ডা মাথায় ছক কষে প্রদেশ কংগ্রেসকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া হলো৷ আর একটু স্পষ্ট করলে, শিক্ষা দেওয়া হলো প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে৷ আর শিক্ষার তেজ এতটাই ছিলো যে ব্রিগেড সভা শেষের আগেই মঞ্চ ছাড়তে হলো অধীর চৌধুরিকে৷
একুশের ভোটের ঝাঁজ বাড়িয়ে এবারের প্রথম ব্রিগেড সমাবেশ হলো কং-বামের। সঙ্গী সদ্য রাজনীতির ময়দানে পা রাখা আব্বাস সিদ্দিকি৷ সিদ্দিকি এদিন যাদের সঙ্গে ‘স্টেজ শেয়ার’ করলেন, তাঁদের অনেকেরই রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে ওই পীরজাদার জন্মেরও আগে৷ তবুও ভোটে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে এবং ২০১৯ -এর লোকসভা নির্বাচনের মতো এবারও যাতে শূন্য হাতে আলিমুদ্দিনে ফিরে যেতে না হয়, সেজন্যই এদিন বামেরা ‘রাজা’র পার্ট দিয়েছিলো আব্বাস সিদ্দিকিকে৷
এদিনের সমাবেশ নামেই ছিলো ‘সংযুক্ত মোর্চা-র৷ প্রচার হয়েছিলো, এই ব্রিগেড শুধু লাল পতাকার নয়, কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের ব্রিগেডও এটা৷ কিন্তু বাস্তবে সে ছবি দেখা যায়নি৷ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিমান বসু, মাইক ও মঞ্চ নিয়ন্ত্রণও ছিলো সিপিএমের হাতে৷ স্রেফ অতিথি হিসাবে কংগ্রেস এই সভায় যোগদান করেছে৷ যদিও অন্য শরিক, ‘সেকুলার ফ্রন্ট’ অনেকটাই বাড়তি খাতির পেয়েছে৷ এই খাতিরটাও বোধহয় পরিকল্পিত ৷ বিমানবাবু সভার শুরুতেই জানিয়েছিলেন, “এই
ব্রিগেড বঙ্গ-রাজনীতিতে অন্য মাত্রা দেবে৷ একদিকে বিজেপি- তৃণমূল, অন্যদিকে আমরা সবাই”৷
আর সভা শেষের পর ধরা গেলো বিমানবাবু ‘আমরা’ বলতে সম্ভবত বামফ্রন্ট ও সেকুলার ফ্রন্টকেই বুঝিয়েছেন৷ ব্রিগেড জমায়েতের আয়তন দেখে আলিমুদ্দিনের ধারনা হয়েছে, বাড়তি অক্সিজেন মিলে গিয়েছে৷ ‘অতিথি’ কংগ্রেসকে আপ্যায়ণ না করলেও ক্ষতি নেই৷ আব্বাস সিদ্দিকির অপরিনামদর্শী মন্তব্যের জেরে এবার যদি কংগ্রেস ‘সংযুক্ত মোর্চা-য় থাকতে না চায় (যদিও তেমনটি বোধহয় হবে না), তাহলে দায় নেবে কে ?
প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরি জীবনে প্রথমবার ব্রিগেড-মঞ্চে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখনই শোরগোল তুলে মঞ্চে ওঠেন আব্বাস৷ আব্বাসকে দেখে দুঁদে সিপিএম নেতারা এমন
আদেখলাপনা শুরু করেন, যেন অবিভক্ত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্রিগেডে এসেছেন৷ বাম উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় ছন্দপতনের সূত্রপাত হয়৷
আব্বাসকে ঘিরে মহম্মদ সেলিমের উচ্ছ্বাসও ছিলো চোখে পড়ার মতো৷ তার আগে বক্তব্য রাখার সময়
অধীর স্লোগান তোলেন, “ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, সরকার গিরনা বাকি হ্যায়”। কিন্তু ‘ঝাঁকি’-টা যে খানিক পর তাঁর দিকেই ধেয়ে আসবে, এটা তিনি অনুমান করতে পারেননি৷ আব্বাসকে নিয়ে বিমান- সেলিমের দেখে মাঝপথেই বক্তৃতা থামিয়ে চলে যেতে উদ্যত হন অধীর চৌধুরি। স্ক্রিপ্ট-মাফিক অধীর- হেনস্থার ওটাই প্রথম দৃশ্য৷ শেষপর্যন্ত অবশ্য কোনওক্রমে ভাষণ শেষ করেন অধীর চৌধুরি৷
ওদিকে, এটাও ঠিক, কংগ্রেসের সঙ্গে সেকুলার ফ্রন্টের আসন সমঝোতা এখনও চূড়ান্ত আকার নেয়নি৷ সোমবার ফের বৈঠকের কথা৷সোমবারের বৈঠকে অধীর চৌধুরি নিজে থাকলে বৈঠকে আলোচ্যসূচিতে “ব্রিগেড সমাবেশ” যে থাকবে, তা একরকম নিশ্চিত৷ এই ইস্যুতে পরিস্থিতি আরও জটিলও হয়ে যেতে পারে৷ বামেরা তাঁকে ৩০ আসন ছেড়েছে বলে আব্বাস কতখানি আপ্লুত তা প্রকাশ্যেই বোঝান৷ তারপরই পরিবেশ, পরিস্থিতি, স্থান, কাল, পাত্র এবং জোটধর্ম ভুলে
তোপ দাগেন কংগ্রেসের দিকে৷ জোট-রাজনীতিতে এক শরিক, অন্য শরিককে প্রকাশ্য সভায় বিঁধছেন, বামফ্রন্টের অন্দরে এমন ছবি বারবার দেখা গেলেও, যে তথাকথিত জোট এখনও ভূমিষ্ঠই হয়নি, সেই জোটে এই ছবি বেনজির৷ ‘সংযুক্ত মোর্চা’ এখনও এক পা’ও হাঁটেনি, তা জেনেও সেকুলার ফ্রন্ট নেতা আব্বাস সিদ্দিকির এই ‘মন কি বাত’ প্রস্তাবিত জোটের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তলানিকে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তাৎপর্যপূর্ণ এক নির্বাচনের প্রাক্কালে একসঙ্গে বিজেপি আর তৃণমূলের মোকাবিলা করে রাজ্যের মসনদে বসার দাবি জানাচ্ছে যে জোট, সেই জোটের এক নেতা গর্ভাবস্থায় জোটকে খুন করার চেষ্টা করছে কোন স্বার্থে ? কার স্বার্থে ? জোটের ওই নেতা প্রকাশ্যে বলছেন, “আমাকে যতক্ষণ না আসন ছাড়া হচ্ছে, ততক্ষণ আমি কংগ্রস প্রার্থীদের ভোট দিতে বলবো না৷ আসন ছাড়লেই আমি বলবো কংগ্রেসকে ভোট দিন “৷ ‘বন্ধু’ বলে বারবার বামেদের কথা উল্লেখ করলেও, কংগ্রেসের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যও দেখাননি আব্বাস৷ এখানেই থামেননি আব্বাস৷ কংগ্রেসের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘বন্ধুত্বের রাস্তা খোলা রয়েছে। যাঁরা ভাবছেন, কেন কংগ্রেসের নাম নিচ্ছি না, তাঁদের বলছি, ভিক্ষা চাই না। আমরা অংশীদারি করতে এসেছি, তোষণ করতে নয়। হক বুঝে নিতে হবে।’’
এ কেমন জোট- শরিক ? এ কেমন বকচ্ছপ জোট ? আসন ভাগাভাগি নিয়ে আব্বাসের অসন্তোষ থাকতেই পারে৷ কংগ্রেস যে যে আসন ছাড়তে চাইছে, তা অপর শরিকের পছন্দসই নাও হতে পারে৷ কিন্তু সে আলোচনা তো হবে ঘরের অন্দরে৷ নেতায় নেতায়৷ কথা কাটাকাটি, এমনকী হাতাহাতিও হতে পারে ঘরের ভিতর৷ কিন্তু ভরা বাজারে নিজেরাই নিজেদের উলঙ্গ করার পরেও কি এরা আশা করছে বিজেপি আর তৃণমূল এই ‘সংযুক্ত মোর্চা’র ভয়ে ঘরে ঢুকে যাবে ? ব্রিগেড-মঞ্চে ওই যাত্রাপালার পর এমন জোট না থাকলেই বা কার কার ক্ষতি ?
আব্বাস সিদ্দিকির আদত ‘ফার্স্ট পার্সন’-এ কথা বলা৷ সব সময় একটা ‘আমি-আমি’ ব্যাপার আছে৷ এটা কোনও অন্যায় বলে মনে করার কারন নেই৷ রাজ্যের একাধিক নেতা-নেত্রীও এমন করে থাকেন৷ নিজের বৃত্তে নিজের মানুষের কাছে এমন ভাবপ্রকাশ করতেই পারেন৷ কিন্তু বড় মাঠে খেলতে নামলে সংযম দেখাতে হয়৷ রাজনৈতিক আঙ্গিনার সঙ্গে এখনও সড়গড় হননি আব্বাস৷ ধর্মীয় কারনে পিছনে জনসমর্থন থাকা এক কথা৷ সেই জনবলকে মূলধন করলেই রাজনৈতিকভাবে পরিনতমনস্ক হওয়া কিন্তু খুব সহজ নয়৷ বৃহত্তর রাজনৈতিক আঙ্গিনায় প্রবেশ করলে সদা সতর্ক থাকতে হয়৷ স্থূলবুদ্ধি বা আমিত্বের দ্বারা চালিত হলে যে কেউ এর সুযোগ নেবেই৷ তেমনই কেউ সুযোগ নিয়েছে কি’না, ঈশ্বর জানেন৷
এই ঘটনার পর রাজনৈতিক মহল ঠিক এমন কথাই বলছে৷ বলছে, পছন্দের কারো কথায় প্রভাবিত হয়েই আব্বাস সিদ্দিকি সম্ভবত এ ধরনের ‘বিপ্লব’ ঘটিয়েছেন৷ সিপিএমের সঙ্গে আব্বাসের সখ্য বেশ মাখোমাখো৷ ওই দলে এমন অনেকেই আছেন যারা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে ‘শত্রু’ ভাবেন৷ জোট আলোচনায় একাধিকবার অনড় ভূমিকা নিয়ে আলিমুদ্দিনের নানা প্রস্তাব
উড়িয়ে দেন অধীরবাবু৷ উত্তরবঙ্গে কংগ্রেসের নিশ্চিত আসনগুলি চেয়ে আব্বাস যে দাবি করেছে, তাও মানেননি তিনি৷ সিপিএম আতঙ্কিত, এই কারনে যদি আব্বাস জোট ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তো খালি ব্যাগ নিয়েই ঘরে ফিরতে হবে৷
ওদিকে আলিমুদ্দিন অনেকটাই কাছে টেনে নিয়েছে আব্বাসকে৷
আব্বাসের সঙ্গে আলিমুদ্দিনের সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই ভালো। আলিমুদ্দিনের হয়ে এই সম্পর্ক রক্ষা করেন মহম্মদ সেলিম৷ সেলিমকে নিজের শুভার্থী বলেই মনে করেন আব্বাস৷ ফুরফুরার আর এক চর্চিত নাম পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির নিজের ভাইপো এই আব্বাস৷ ত্বহা সিপিএম- বিরোধী বলেই সেলিমের মাধ্যমে এই আব্বাসকে টেনেছে আলিমুদ্দিন৷ ব্রিগেড মঞ্চ থেকে এদিন বার বার সেলিমের দরাজ প্রশংসা করেছেন আব্বাস৷ সব মিলিয়ে রাজনৈতিক মহল নিশ্চিত, পিছন থেকে কলকাঠি নাড়িয়েই আব্বাসকে দিয়ে অধীর চৌধুরিকে বিব্রত করার কাজ করানো হয়েছে৷ জোট থেকে কংগ্রেসের এখন বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুবই সংকীর্ণ৷ তবে অসম্ভব নয়৷
সেই পরিস্থিতিতে আব্বাসকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ জল্পনা চলছে, আলিমুদ্দিনের যে অংশ অধীরকে পছন্দ করেন না, তেমন কেউ বা কারা এই ছক সাজাননি তো ?
পিছনের গল্প যাই হোক, রবিবারের ব্রিগেড দেখে আলিমুদ্দিন উল্লসিত হলেও, সামগ্রিকভাবে জোট এর ফয়দা কতখানি তুলতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্নও তুলে দিলো এই ব্রিগেডই৷ কংগ্রেস যদি আব্বাসের মনের মতো আসন ছাড়তে রাজি না হয়, তাহলে আব্বাস বা
কংগ্রেস, কেউই অপরের প্রার্থীকে ভোট দিতে বলবেনা৷ শুধু তাই নয়, একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থীও দিতে পারে৷ সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে দায়ী হবে আব্বাস সিদ্দিকির ব্রিগেড-ভাষণ৷
আর তারপরেও নাকি বলা হবে, কংগ্রেস, বাম এবং সেকুলার ফ্রন্ট এই “সংযুক্ত মোর্চা” গঠন করেছে বিজেপি ও তৃণমূলকে হারাতে৷ আশঙ্কা, তেমন হলে রবিবারের ব্রিগেডকে রাজনৈতিক মঞ্চ না বলে, কেউ না আবার “স্ট্যাণ্ড-আপ কমেডি”-র মঞ্চ বলে তকমা সাঁটান৷