
কালীপুজোর রাত। রাত জাগা হচ্ছে প্যান্ডেলে। রাত জাগা মানে দেদার মদ, এ কথা বলাই বাহুল্য। এক নিশ্বাসে বোতল শেষ করার চ্যালেঞ্জ। ছোটরা ৩৭৫। বড়রা ৭৫০। সঙ্গে মাছ মাংস ডিম। রাত তিনটে পর্যন্ত হুল্লোড়ের পর অনেকের ক্লান্তি এল। কেউ কেউ কাঁদল। কেউ আবার অসুস্থ। লেবু খাইয়ে শুশ্রূষা। ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে ক্লাবঘরে শুইয়ে দেওয়া।
এরপর থেকে ভোরের বাতাস বওয়া শুরু হয়। ঘুম আসে। গাছের তলায় বেঞ্চে চিৎ হয়ে শুলে গাছের মধ্যে নৃত্যরতা যুবতী দেখা যায়। চারটের দিকে কাঁটা ঘোরে। অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে তখনও আলো ফোটে না। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসতে মন চায়। প্রাচীন কালী মন্দির। সুপ্রাচীন শশ্মান। এই সময় গঙ্গা টানে। চিতাকাঠও টানে হয়ত!
সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা লাগাতে হয়। হাঁটা লাগাবার কিছু নেই। মাত্র কয়েক পা। সামনে একটি বৃদ্ধা কে দেখা যায়। সাদা শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত। সামনে ঝুঁকে প’ড়ে চলছে। গতি দ্রুত। তাঁকে অনুসরণ করতে হচ্ছে। কিছুতেই পেরিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। অতি সামান্য পথ। শেষ হচ্ছে না কেন? পেটে মদ যেমন আছে, মস্তিষ্কে গঞ্জিকার ধোঁয়াও গেছে জড়িয়ে। সম্ভবত সেই কারনে বৃদ্ধা কে পেরিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এই বৃদ্ধার হাঁটা, তাঁকে অনুসরণ করা, পেরিয়ে যেতে না পারা, এসব কিছু যেন হচ্ছে না! যেন অভিনীত হচ্ছে।
অনেক পরে। কত পরে বলা অসম্ভব। সত্যিই অনেক পরে কি না, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। বৃদ্ধা গঙ্গার ধারে এসে পৌছলেন। অনুসরণও দাঁড়িয়ে পড়ল পিছনে। বৃদ্ধার হাতে ফুলের সাজি। বৃদ্ধা পিছন ফিরে তাকালেন। অস্পষ্ট মুখ। নেশা, ঘুম সব মিলিয়ে হয়ত অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বৃদ্ধা ফুল পাড়তে গাছের তলায় দাঁড়ালেন। তারপর সব নেশা, সব ঘুম, সব বোধ কে স্তম্ভিত করে টিকটিকি যেমন দেওয়ালে চড়ে সেই ভাবে বুক ঘষে ঘষে উঠে পড়লেন গাছে। মিলিয়ে গেলেন পাতার ভিতর।
অনুসরণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল খানিকক্ষণ। তারপর মড়া পোড়ানোর নিমিত্ত জড়ো করা কাঠের স্তুপে বসে পড়ল। পূর্বাকাশ লালচে হল। পাখিরা জেগে উঠল। গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়ে গেল কাক বক মাছরাঙা। গঙ্গা স্নানের জন্য একে একে আসতে লাগলেন ভোরে ওঠা মানুষ। তারপর সূর্যও উঠল। শুরু হল জাগরণ। সেই বৃদ্ধা আর নামলেন না গাছ থেকে।
ভাঁড়ের গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অনুসরণও ভুলে গেল বৃদ্ধার কথা।